১১ নভেম্বর ২০০৯

সায়েন্স ফিকশন
ম্যাডিনাসের আগন্তুক
ফয়সাল মাহমুদ

অজু করতে গিয়ে তফিজ মিয়া ঝোপের ভিতর কিছু একটার নড়াচড়া দেখতে পেলেন। তিনি কে কে? বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আবার অজু করতে বসলেন। তফিজ মিয়া বাইতুল হিকমাহ জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন। খুব পরহেজগার বলে তার একটা সুনাম আছে। কিছু লোকের ধারণা তিনি জিন-পরী নিয়ে কারবার করেন। জীন-পরী ধরে ধরে বোতলে ভরে রাখেন। অনেকে আবার একটু বাড়িয়ে বলে যে তারা নাকি তফিজ মিয়াকে অদৃশ্য ধমকাতে দেখেছেন। কিন্তু আসল ঘটনা হল তফিজ মিয়া ভিতু ধরনের একজন মানুষ। জীন-পরী বোতলে ভরে রাখাতো দুরে থাক তাদের ভয়ে পারলে তিনিই বোতলে ঢুকে থাকেন। ফজরের আজান দেয়ার জন্য তাকে শেষ রাতের দিকে মসজিদে আসতে হয়। বাড়ী থেকে বের হওয়ার সময় যত রকম দোয়া আছে সেগুলো পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে বের হন। বের হবার পর মসজিদ পর্যন্ত প্রায় চোখ বুজে দোয়া পড়তে পড়তে মসজিদে উপস্থিত হয়ে হঁ্বাফ ছাড়েন।
দ্বিতীয়বার তিনি ঝোপের ভেতর নড়াচড়া দেখতে পেলেন। আবার তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন কে! কে ওইহানে?” একটা অজানা আতঙ্ক তাকে ঘিরে ধরল। এত রাতে এখানে কে আসবে? তাহলে কি?---। তিনি দ্রুত সব দোয়া পড়তে লাগলেন। এই সময় ঝোপের ভিতর থেকে এক অপার্থিব ভয়ঙ্কর দর্শন প্রাণী বের হয়ে এলো। ৪ ফুট লম্বা অনেকটা মানুষের মত। কিন্তু মুখটা খুব ভয়ঙ্কর। মাথাটা শরীর হিসাবে বড়। চোখ দুটো কোটরাগত। তফিজ মিয়া হিস্টোরিয়া রোগীর মত কাঁপতে লাগলেন। প্রাণীটা তার কাছাকাছি এসে যন্ত্র কণ্ঠে বলল “আপনার সাহায্য চাই”। তফিজ মিয়া সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে পরে গেলেন।
জ্ঞান ফেরার পর তফিজ উদ্দিন বুঝতে পারলেন না যে তিনি কোথায় আছেন। চারপাশে অনেক লোক জড়ো হয়ে আছে। তাদের মধ্যে ইমাম সাহেব ও আছেন। তফিজ মিয়া বুঝতে পারলেন যে তিনি বাড়িতে আছেন। ইমাম সাহেব বললেন কি মিয়া ফিট হইলা ক্যমনে। ডরাইছিলা নাকি? সবাই তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়া আছে। এমন সময় তার মনে পড়লে যে তিনি অজু করছিলেন। এমন সময় ভয়ংকর দর্শন এক প্রাণী তার কাছে এসে মানুষর মত বলল, “আপনার সাহায্য চাই,” প্রাণীটার চেহারা মনে পরে তফিজ মিয়া আবার জ্ঞান হারালেন।
ভয়ংকর একটা দুঃস্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভাঙ্গলো। ঐ ভয়ংকর দর্শন প্রানীটা একটা ত্রিশূল হাতে নিয়ে তার দিকে ছুটে আসছে। তিনিও রীতিমত দৌড়াচ্ছেন। এক সময় জন্তুটা তার খুব কাছাকাছি এসে গেল। এমন সময় তার পায়ে গাছের মত শিকড় হয়ে মাটিতে লেগে গেছে। তিনি অনেক চেষ্টা করেও সামনে এগোতে পারলেন না। চিৎকার দিতে গেলেন। কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের হল না। প্রাণীটা তার সামনে এসে অপার্থিব হাসি হাসছে। এমন সময় বিকট চিৎকার দিয়ে তার ঘুম ভাঙলো। ঘরের ভিতর যারা ছিল তারা প্রচন্ড চমকে উঠলো। তার মাথার কাছে বসে ইমাম সাহেব সূরা ইয়াছিন পড়ছিলেন। চিৎকার শুনে তার পড়া থেমে গেছে। ঘরে বেশি লোক নেই ইমাম সাহেব, মসজিদের খাদেম মাহতাব আর তফিজ মিয়ার একমাত্র মেয়ে ১১ বছরের লুৎফন। মেয়েটা তার পায়ের কাছে বসে ফুঁপিয়ে বলল বাজান তুমি এমন করতাছো ক্যান? কি হইছে তোমার? মেয়েটার কথা শুনে তফিজ মিয়ার চোখে পানি এসে গেল। মেয়েটা বড় মায়াবতী কিন্তুু অসহায়। তার চোখগুলো অনেক সুন্দর। সৃষ্টিকর্তা তাকে অনেক সুন্দর চোখ দিয়েছেন। কিন্তু তাতে আলো দেননি। পৃথিবীর অনেক চমৎকারও ভয়ঙ্কর সৌন্দার্য থেকে সে বঞ্চিত। ইমাম সাহেব বললেন “তফিজ তোমার কি হইছে তুমি কি জিন টিন দেইখা ভয় পাইছো নাকি? তফিজ চুপ করে রইলো। ইমাম সাহেব বললেন, বুঝছি “এখন কইবানা ঠিক আছে যহন মনে চাইবে তহনই কইয়ো যাই নামাজের টাইম অইছে। তুমি ভালো থাইকো। আমি পারলে নামাজের পর আবার আসুম নে। ইমাম সাহেব চলে যাবার পর মেয়েটা তার মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। তুমি মিয়া আবার ভাবতে লাগলো মেয়েটা আসলেই জনম দুঃখী জন্মের সময়ই মা মারা যায় তার। মায়ের আদর থেকেও সে বঞ্চিত। তফিজ মিয়া পানির তৃষ্ণা অনুভব করলেন। মেয়েকে বললেন “মা আমারে একটু পানি খাওয়াইতে পারিবা”। লুফুন উৎসাহে বলে উঠল ” পারমু না ক্যান অক্ষণই আনতাছি।” মেয়েটা দেয়াল হাতরে হাতরে পানি আনতে চলে গেল।
এমন সময় শার্ট -প্যান্ট পরা এক লোক ঘরে ঢুকলো। তফিজ মিয়ার কাছাকাছি এসে যন্ত্র কন্ঠে বলল, আপনার সাহায্য চাই” অবিকল সেই ভয়ংকর দর্শন প্রাণীর মত। তফিজ মিয়ার মনে ভয় জেগে বসল। তিনি বললেন আপনে কেডা? লোকটি বলল “আমি এসেছি ম্যাডিনাস থেকে আমার নাম এপতান। এমুন নামতো জীবনে শুনি নাই। এইডা কোন জায়গা? তছির বলল।
এপতাব বলল, “আপনি শুনবেন কিভাবে। পৃথিবী থেকে অনেক অনেক দূরে আমাদের গ্রহ। পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানীও এটার সন্ধান এখন পর্যন্ত পায়নি।
তফিজ মিয়া অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে এপতানের দিকে তাকালো। ভাবলো, লোকটা মনে হয় পাগল। কি সব ম্যাডিনাস বলেছে। এপতান তফিজের দৃষ্টি বুঝতে পেরে বলল, “আজ ভোরে আপনি যে প্রাণীটা দেেিছলেন সেই আমি”। এবার তফিজ মিয়ার চোখ উল্টো যাবার মত অবস্থা। এপতান বলল “ভয় পাবেন না। আমি আপনার কোন ক্ষতি করবো না। আপনি তোমাকে দেখে ভয় পেয়েছিলেন বলে আমি মানুষের রূপ নিয়ে এখানে এসেছি। আর আমি কিন্তু আমার গ্রহের ভাষায়ই কথা বলছি। একটা যন্ত্রের মাধ্যমে তা রূপান্তরিত হয়ে আপনার ভাষায় শোনা যাচ্ছে। এখন আসল কথা হচ্ছে আমি আপনার সাহায্য চাই। তফিজের ভয়টা এখনো যায়নি। সে বলল তাপনেরে আমি ক্যমনে সাহায্য করমু। এপতান বলল “আমি বের হয়েছিলাম গ্রহ ভ্রমণে। এই সবজি গ্রহটা দেখে ভাবলাম এখানে ল্যান্ড করি। কিন্তু ল্যান্‌ করার সময় গাছের সাথে বাড়ি খেয়ে স্পেসসীপের মূল কম্পিউটার অনেক ক্ষতি হয়। এখনই এই কম্পিউটার ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমি যেতে পারবো না।। এটা ঠিক করার জন্য আপনার সাহায্য দরকার। তফিজের ভয় এবার কিছুটা কমেছে। সে বলল আমি অশিক্ষিত মানুষ আমি এইটা ঠিক করমু ক্যমনে?” এপতান বলল “আপনাকে কিছুই করতে হবে না আমি শুধু আপনার মাথাকে কিছুক্ষণের জন্য ব্যবহার করতে চাই। তফিজ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল “জি মানে”। এপতান বলল “আমি একটা পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছি যে আমার মূল কম্পিউটারের চেয়ে মানুষের ব্রেন বেশি কার্যকরী। আমি কিছুক্ষণ আপনার ব্রেইন ব্যবহার করে আমার স্পেসসীপটা চালু করলেই আপনার কাজ শেষ।” তফিজ মিয়া লজ্জা পেয়ে বলল, কি যে বলেন, আমার যদি এত বেরেন থাকতো তাইলে আমি জজ ব্যারিস্টার অইতাম।”
এপতান বলল “আমি ও তো তাই বুঝতে পারছিনা যে আপনাদের মস্তিস্ক এত কার্যক্ষম হওয়া সত্ত্বেও আপনারা এক পিছিয়ে আছেন কেন? কিন্তু আমাদেরকে দেখুন আপনাদের পৃথিবীর লোকের তুলনায় আমাদের ব্রেইন তিন ভাগের এক ভাগ। অথচ আমারা তা কাজে লাগিয়ে আপনাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছি। আমাদের প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে আপনাদের আরো ১০০ বছর লেগে যাবে। এখন আপনি বলুন আমাকে সাহায্য করবেন কিনা। তফিজ মিয়া জড়ানো কনেণ্ঠ বলল, “আমার যদি কিছু হইয়া যায় তাইলে আমার মা মরা মাইয়াটা ক্যমনে থাকবো? এপতান বলল আপনার কিছুই হবে না। তফিজ চোখ মুছতে মুছতে বলল চলেন”। তফিজ এপতানের পিছন পিছন ঝোপের ভিতর ঢুকলো। তারপর দেখলো। বিশাল গামলার মত একটা জিনিস। ওপরে কাচের ঢাকনা। ভিতরে কয়েকটা লাইট জ্বলছে আর নিভছে। এপতান বলল “এখানে শুয়ে পড়ুন”। তফিজ শুয়ে পড়লো। তার মাথায় হেলমেট জাতীয় একটা জিনিস লাগানো হল। কিছুক্ষণ পর তার চোখের সামনে সব অচেনা দৃশ্য ভেসে উঠলো। একবার দেখলো এক কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করছে। আবার দেখলো পিঁপড়ার মত একটা জিনিস তবে বিশাল বড়। চারদিকে বিশাল বিল্ডিং। সব অপরূপ দৃশ্য। কিছুক্ষণ পর তার চোখের সামনে সব থেমে গেল। এপতান তফিজের মাথা থেকে হেলমেটটা খুলে ফেলল। এপতান তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল “উঠে আসুন কাজ শেষ।” তফিজ উঠে এল। তার মাথা ব্যথা করছে। এপতান বুঝতে পেরে বলল ব্যথাটা কিছুক্ষণ পরে চলে যাবে। আর আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি সাহায্য না করলে আমি হয়তো আমার গ্রহে ফিরে যেতে পারতাম না।” এপতান তফিজ মিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। তফিজ মিয়ার চোখে পানি এসে গেল। সে এত ভাল লোক জীবনে দেখেনি। এপতান বলল আমার পক্ষে থেকে আপনার জন্য ছোট্ট একটা উপহার আছে। সেটা পরে বুঝতে পারবেন। আশা করি সেটা আপনাকে খূশি করবে।” এপতানের দেহটা পাল্টাতে শুরু করলো। আবার সেই ভয়ংকর রূপ ধারণ করলো। তবে তফিজ মিয়া এবার আর ভয় পেলোনা। বরং এপতানকে তার কেমন যেন আপন মনে হল। এপতান স্পেসসীপের ভিতর ঢুকতেই কাচের ঢাকনাটা লেগে গেল। ভিতর থেকে তফিজের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো। এপতান, তফিজ ও হাত নেড়ে বিদায় জানালো।
স্পেসসীপটা আস্তে আস্তে উপরের দিক উঠতে উঠতে শূন্যে মিলিয়ে গেল। বাড়িতে ঢুকতেই তফিজের চিন্তা হল মেয়েটা এতক্ষন কিভাবে একা একা ছিল। নিশ্চয় ভয় পেয়েছে একা একা। তফিজ জোর গলায় ডাকলেন, “মা লুৎফুন, কই গেলি রে মা” লুৎফন ঘরের ভিতর থেকে কেমন করে যেন হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে এল। তফিজ মিয়া ভয় পেয়ে গেল। তার মেয়ে এভাবে হাঠছে কেন? তিনি প্রায় দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে ধরলেন যেন পরে না যায়। মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি আমার বাজান?” তফিজ মিয়া ভয় পেয়ে গেলেন। তার মেয়ে এসব কি বলছে। তফিজ মিয়া বলল ক্যান রে মা তোর হইছে?” মেয়েটা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “বাজান আমি সব দেখতে পাইতাছি” তফিজ মিয়ার গলা দিয়ে কিছুক্ষণ কোন কথা বের হলোনা। তিনি বুঝতে পারলেন যে এটা এপতানের উপহার। তিনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। লুৎফুন ও তার বাবাকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলো। তফিজ মিয়া এপতানের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করল।
বাবা আর মেয়ে দুজনে পুকুরের পাশে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। লুৎফুন বলল, “বাজান ওইডা কি?” তফিজ মিয়া বলল, ওইডা হইল আকাশ। আকাশে ছোট্ট ছোট্ট ঐগুলি কি বাজান? ‘ঐ গুলান হইলো তারা। বাজান দ্যাহো একটা তারা চইলা যাইতাছে। “ঐডা তারা না,ঐডা হইল এপতানের গাড়ি। এপতান হইলো ম্যাডিনাসে থাকে। ম্যাডিনাস কি বাজান? ম্যাডিনাস হইলো একটা গ্রহ, তফিজ বলে। গ্রহ কি বাজান? তফিজ বুঝতে পারলো মেয়ের প্রশ্ন আজ আর শেষ হবে না। অবশ্য প্রশ্নের উত্তর দিতে তার খারাপ লাগছে না। সে ভাবলো আজ সারারাত মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দিয়েই কাটিয়ে দেবে। মেয়েটা কিছুই চেনেনা তাকে সব চেনাতে হবে।
সুএ : http://www.bbaria.com/kanamachi/science.html